লড়াই থেকে পিছু হটলেন হাসান মশহুদ : পর্ব-এক

২০০৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই হাসান মশহুদ চৌধুরী (অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল) বলেছিলেন, ‘এবার পদত্যাগ নয়, এবার লড়াই হবে।’ কথাটি তিনি বলেছিলেন তাঁর অতীতের দিকে তাকিয়ে। কেননা রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের প্রথম পর্বের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার পদ থেকে যে চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন, তাঁদের মধ্যে তিনিও ছিলেন।

কিন্তু এবারও লড়াই নয়, শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করলেন হাসান মশহুদ। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দায়িত্ব নেয়ার পর ২৫ মাস ও বর্তমান সরকারের আমলে ৮৮ দিনের মাথায় গত দুই এপ্রিল তিনি পদত্যাগ করলেন। পদত্যাগ পত্রে তিনি কোন কারণ উল্লেখ না করলেও বিদায়ের সময় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলেছেন, ‘পদত্যাগের ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন নেই। আমি মনে করি, বর্তমানে এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে দুদকের কাজ এগিয়ে নেয়ার জন্যে নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজন। তাই আল্লাহর ইচ্ছায় পদত্যাগ করেছি। এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু এখন বলবো না।’

তাঁর এই পদত্যাগ ভবিষ্যতের জন্যে কী তাৎপর্য বহন করছে? তা কি সামরিকতন্ত্রের সঙ্গে ক্ষমতাকাঠামোর যে নীরব দ্বন্দ্ব রয়েছে তাকে উৎসাহিত করবে? তা কি দুদককে দলীঁয়করণের দুয়ার খুলে দিলো? বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ কিংবা বিরোধী দল বিএনপি উৎসাহ দেখালেও এবং কেউ কেউ এ পদত্যাগে আনন্দিত হলেও দুদককে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেয়ার ক্ষেত্রে ঘটনাটি কতটা ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক দৃষ্টান্ত হলো?

এ বিষয়গুলি নিয়ে সবার মন্তব্য আশা করছি। আর এই মন্তব্য নির্মাণের স্বার্থে গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যে-সব সংবাদ ছাপা হয়েছে, যাতে পদত্যাগের এ ঘটনা এবং অতীত প্রেক্ষাপট ইত্যাদি তুলে ধরা হয়েছে তার একটি সংক্ষিপ্ত রুপ তুলে ধরছি। দ্বিতীয় পর্বে এ ঘটনার সর্বশেষ পরিস্থিতি এবং বিভিন্ন জনের প্রতিক্রিয়া (সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে) তুলে ধরা হবে। উল্লেখ্য, নিচের পুরো বিবরণই বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে নেয়া। আমাকে বড়জোর গ্রন্থক বলতে পারেন। তথ্যসূত্রের উল্লেখ করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু নোট নেয়ার সময় তা রাখতে পারিনি বলে দুঃখিত। তবে এতে তেমন কোনও অসুবিধা হবে না বলে আশা করি।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বেশ কয়েকবার তার পদত্যাগ করার কথা শোনা গেলেও বারবার তিনি তা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিচারপতি সুলতান হোসেন খানের নেতৃত্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনকে পুনর্গঠন করে সাবেক এ সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে নতুন কমিশন গঠন করে। এরপরই শুরু হয় বহুল আলোচিত-সমালোচিত দুর্নীতি দমন অভিযান। দেশের শীর্ষ দু’নেত্রীসহ শতাধিক রাজনীতিবিদ গ্রেপ্তার হন। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন হাসান মশহুদ চৌধুরী। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন রাজনীতিবিদরা। সংসদ অধিবেশনে সরকারি ও বিরোধী দলের একাধিক এমপি তার পদত্যাগ দাবি করেন। তার বিরুদ্ধে ট্রাস্ট ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ ওঠে। তবে দুদক তা থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়। এরপর গত বুধবার অনেকটাই হুট করেই তিনি পদত্যাগ করেন।

রাষ্ট্রপতির কাছে দেয়া পদত্যাগ পত্রে হাসান মশহুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর ১০(১) ধারা অনুযায়ী দুদকের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একই ধারা অনুসরণে এই পত্রটি এক মাসের নোটিশ হিসাবে গণ্য করে আগামী এক মে পর্যন্ত এক মাসের ছুটি মঞ্জুরের সবিনয় অনুরোধ জ্ঞাপন করছি।’

দুর্নীতির বিষয়টি এখনও সুরাহা হয়নি

পদত্যাগের পর এক আনুষ্ঠানিক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিকালে হাসান মশহুদ চৌধুরী আরও বলেন, ‘দুর্নীতির বিষয়টি এখনও সুরাহা হয়নি। এটা আমরা সবাই জানি। এ কাজটিতে এখনও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে কাজ করার। আমার প্রত্যাশা ও আশা থাকবে ভবিষ্যতে যারা দুদকের নেতৃত্ব দেবেন তারা এই কাজটিকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আমাদের সফলতা বা ব্যর্থতা যাচাই করার সময় এখনও আসেনি বলে আমি মনে করি। যেহেতু সমস্যাটা কঠিন। অতএব সময় নিয়েই এর সুরাহা করতে হবে। তবে আমাদের প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো যদি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে থাকে তাহলে আমি মনে করি আমাদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন হবে।’

তবে কি কারণে পদত্যাগ করেছেন? এ প্রশ্নের কোনও উত্তর তিনি সাংবাদিকদের দেননি। দুর্নীতি দমন, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলের সার্বিক সমর্থনের কথা জানিয়ে হাসান মশহুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমার এবং দুদকের অনেক শুভাকাক্ষী ছিলেন। আপনারাও তাদের মধ্যে আছেন। দেশের ভিতরে-বাইরে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেকেই আমাদের কার্যক্রমকে লক্ষ্য রেখেছেন। আমরা তাদের সেই সমর্থন অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। আজকের এই বিদায়বেলায় তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক ধন্যবাদ জানানোর জন্য আমি আপনাদের মাধ্যমে এই সুযোগ নিচ্ছি। দুদক-এ বড় ভাবে কাজ কি কি হয়েছে সেটা আপনারা জানেন। প্রতিকার ও প্রতিরোধ নিয়ে আমরা কাজ করেছি। এ দু’টো বিষয়ে বিভিন্ন মহলের সমর্থন আমাদের প্রয়োজন ছিল, সেটা পেয়েছি। সেক্ষেত্রে আমরা কতটুকু করতে পেরেছি আপনারা অবগত আছেন।’

তিনি বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে পুরো দেশবাসীর মনে সচেতনতা জাগানোর কাজে গণমাধ্যমগুলোই দুদক-এর সবচেয়ে বড় সহায়ক ছিল। সেজন্য তিনি সকলের কাছে কৃতজ্ঞতা জানান।

দায়িত্ব নেয়ার পর যা বলেছিলেন হাসান মশহুদ চৌধুরী

২২ ফেব্রুয়ারি চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার পর ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি দুদক-এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব নিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এবার লড়াই হবে। পদত্যাগ হবে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে সফল হওয়ার জন্য দুদক-এ এসেছি। দেশ এখন ভালর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দুদক চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ পেয়ে ওই রাতেই তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, দুদক-এর অবস্থা যেন আগের মতো না থাকে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর একটি কমিশনে পরিণত করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সব রকমের আশ্বাস দিয়েছেন। তবে সময় দিতে হবে।

তখন তিনি আরও বলেছিলেন, আগে যে কমিশন ছিল তা কাজ করতে পারেনি। আমরা কখনও সে অবস্থা মেনে নেবো না। আমি মনে করি ও প্রত্যাশা করি যে অসুবিধার জন্য আগে এ কমিশনটিকে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। এখন আর সে অবস্থা থাকবে না। যত বাধাই আসুক না কেন ভবিষ্যতে আমরা কাজ চালিয়ে যাবো। সকলের সহায়তা নিয়ে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবো।

হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে যত মামলা

দুদক পুনর্গঠন হওয়ার পর চেয়ারম্যান হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গত বুধবার বিদায় নেয়ার আগ পর্যন্ত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আমলা ও বিচারপতিসহ বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রায় দেড় হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে। নাইকো, বার্জমাউন্টেড ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেমোরিয়াল ট্রাস্টের টাকা আত্মসাৎ ও অন্যান্য অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের করে দুদক। একইভাবে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নাইকো, গ্যাটকো, বড়পুকুরিয়া ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা দায়ের করা হয়। খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা দায়ের করা হয়। সর্বশেষ এ বছরের শুরুতে আট শতাধিক অভিযোগের অনুসন্ধান ও আট শতাধিক মামলা তদন্ত শুরু করে দুদক।

একই সঙ্গে দুদকের ৩৪১টি ও পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থার দায়ের করা ৪৯৫টি মামলারও তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে দুদক। আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, কামাল আহমেদ মজুমদার এমপি ও তার স্ত্রী, বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এয়ার ভাইস মার্শাল আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ব্যবসায়ী এমএ হাসেমসহ ১৭০ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের করা ৮১টি মামলা বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। ২০০৭ সালে দুদক পুনর্গঠিত হওয়ার পর এ পর্যন্ত দুদক ৪৭২টি এবং পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থা ৭১০টি মামলা দায়ের করে। চার্জশিট প্রক্রিয়াধীন রয়েছে ১৫১টি। ১৫১টি মামলার বিচারকাজ উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে।

বিশেষ জজ আদালত ছাড়াও অন্যান্য আদালতে ২৮৯টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলায় ১৫১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছে আদালত। সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ দেয়া হয়েছে প্রায় ৪৫০টি। এর মধ্যে ৩৩৫টি নোটিশের জবাবে তথ্য বিবরণী জমা দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ১১টি নোটিশের তথ্য বিবরণী জমা না দেয়ায় মামলা হয়েছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। এদের ছয়জনকে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। ৯০টি নোটিশের তথ্য বিবরণী জমা দেয়ার এখনও সময় রয়েছে। ২৪০টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে দুদক। সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ ৩৪০ জন ব্যক্তি এসব মামলার আসামি ছিলেন। এসব মামলায় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সালমান এফ. রহমানসহ ৫০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি জেলও খেটেছেন।

দুদকের করা মামলার মধ্যে এ পর্যন্ত ১২৫টির রায় হয়েছে। এতে কারাদণ্ড হয় অর্ধশতাধিক রাজনীতিবিদের। অবশ্য উচ্চ আদালতে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিম্ন আদালতে বিচারাধীন ও বিচার সম্পন্ন হওয়া প্রায় সব মামলার কার্যক্রমই এখন স্থগিত। আসামি রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রায় সবাই মুক্ত আছেন জামিনে। দুদকের প্রায় সব কার্যক্রম নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। হাইকোর্ট ইতিমধ্যে অনেক কার্যক্রম অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন।

ফিরে দেখা : তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিদায়ের পর

রাজনীতিকদের অভিযোগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের শাসনামলে দুদক কেবল রাজনীতি দমনের জন্যই কাজ করেছে। তাদের মামলার কারণে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হতে হয়েছে শীর্ষ পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের। অবশ্য সদ্য পদত্যাগ করা দুদক চেয়ারম্যান বারবারই অস্বীকার করেছেন এ অভিযোগ।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল জয় পেয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুদককে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। গত ২১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন দুদক চেয়ারম্যান। প্রধানমন্ত্রী তাকে সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়ার পর হাসান মশহুদ সাংবাদিকদের বলেন, দুদক সরকারকে সঙ্গে নিয়েই দুর্নীতি প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে চায়।

এরপর গত চার ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে দুদকের কার্যক্রমের সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি দুদক পুনর্গঠন করার কথাও বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুরুতে দুদকের কার্যক্রম ভালোই ছিল। এ রকম ঝাঁকুনির প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু যখন দুর্নীতি দমনের নামে নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন শুরু হলো, দুর্নীতি খুঁজতে গিয়ে রাজনীতি দমন শুরু হলো, মাইনাস টু মাইনাস ওয়ানে চলে গেল, তখনই এ অভিযান প্রশ্নবিদ্ধ হলো। বড় দুর্নীতিবাজরাও হাতছাড়া হতে থাকল।’

তিনি বলেন, দুদককে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত রাখা হবে। একে পুনর্গঠন করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই দেশে দুর্নীতি কমবে।

প্রধানমন্ত্রীর এই অভিযোগ তোলার পরদিন পাঁচ ফেব্রুয়ারি তা অস্বীকার করেন দুদক চেয়ারম্যান হাসান মশহুদ চৌধূরী। তিনি দুদকের সব কার্যক্রম বৈধ ছিল বলে দাবি করেন।

সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগেই রাজনীতিবিদরা দুদকের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। গত এক ফেব্রুয়ারি সংসদে সরকারদলীয় সাংসদ ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর দুদকের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, সংস্থাটি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলও জাতীয় সংসদে দুদকের সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। জোট সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদও দুদকের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

দুদক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মাহমুদুর রহমানের অভিযোগ ও অব্যাহতি

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলের শেষ দিকে অক্টোবর ২০০৮-এ দৈনিক আমার দেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান দুদক চেয়ারম্যান হাসান মশহুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ট্রাস্ট ব্যাংকের ২২ কোটি ৪১ লাখ ৭১ হাজার ১৪০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করেন। আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান লেফটন্যান্ট জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরী ২০০২ ও ২০০৩ সালে তার দায়িত্ব পালনকালে ব্যাংকের অডিটর হোদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং প্রণীত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২২ কোটি ৪১ লাখ ৭১ হাজার ১৪০ টাকা পাচারের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন বলে তার অভিযোগে বলা হয়।

মাহমুদুর রহমান দাবি করেন, হাসান মশহুদ চৌধুরী আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের সম্পদ রক্ষাকারী হিসেবে ট্রাস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে কর্মরত অবস্থায় প্রতিষ্ঠানের সম্পদ অপব্যবহার এবং ক্ষতিসাধন করে পেনাল কোডের ৪০৬ এবং ৪০৮ নম্বর ধারায় অপরাধ করেছেন। তবে গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে হাসান মশহুদ চৌধুরীকে এ অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় দুদক। গত বছরের ২৫ অক্টোবর ওই অভিযোগ আনেন মাহমুদুর রহমান। তিনি ওই দিন দুদক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে রমনা ও মতিঝিল থানায় যান। পুলিশ মামলা না নেয়ায় তিনি অভিযোগটি দুদক-এই পাঠান।

২৯ অক্টোবর দুদক মাহমুদুর রহমানের অভিযোগের প্রাপ্তি স্বীকার করে। অভিযোগটি দুদক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে হওয়ায় বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠায় দুদক। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ অনুযায়ী বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে দুদককেই পরামর্শ দেয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী দুই কমিশনার হাবিবুর রহমান ও আবুল হাসান মনযুর মান্নানের সমন্বয়ে একটি যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। অভিযোগটি যাচাই-বাছাই করে অভিযোগকারী, ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তারা অভিযোগের নিষ্পত্তি করেন।

১৩ কোটি টাকার হিসাব চাইলেন আইন প্রতিমন্ত্রী

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পদত্যাগী চেয়ারম্যান হাসান মশহুদ চৌধূরীর কাছে ১৩ কোটি টাকার হিসাব চেয়েছেন আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, গত দুই বছর রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবীদের ফি বাবদ এই ১৩ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। এসব টাকা তিনি কীভাবে কোথায় খরচ করেছেন, জনগণকে তার হিসাব দিতে হবে। গত দুই এপ্রিল বৃহস্পতিবার আইন মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেন।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, দুদক চেয়ারম্যান পদত্যাগ করায় আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি হয়েছি। গত দুই বছর রাজনৈতিক নেতাদের হেনস্থা করার জন্য তিনি দুদককে ব্যবহার করেছেন। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তিনি মামলা করেছেন। এসব মামলার কোনো ভিত্তি নেই। যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল, তারা এখন মুক্ত।

অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, আমরা একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন চাই। দেশ দুর্নীতিমুক্ত করতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। বর্তমান সরকার দুদককে কোনোভাবেই ব্যবহার করবে না। এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর কোনো কাজে দুদককে অসহযোগিতা করেনি। তবে রাজনীতিবিদদের নামে যেসব মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে, সেগুলো অবশ্যই আইনি মোকাবেলার মাধ্যমে শেষ করা উচিত।

এর আগে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের একটি প্রতিনিধি দল আইনমন্ত্রী ও আইন প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সংগঠনের পক্ষ থেকে তারা আইনমন্ত্রীর কাছে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন। এছাড়া তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আইনমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করেন। প্রতিনিধি দলে সংগঠনের সভাপতি মোঃ আবদুল গফুর, মহাসচিব মোঃ শাহজাহানসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।

পদত্যাগ করতে পারেন দুই কমিশনারও

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারমানের পদত্যাগের পর দুই কমিশনার মোঃ হাবিবুর রহমান ও আবুল হাসান মনযুর মান্নান পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। জানা গেছে, চেয়ারম্যান লে. জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধূরী পদত্যাগ করার কারণেই তারা নিজেরাও পদত্যাগের চিন্তা করছেন। তবে এ ব্যাপারে তাদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

২০০৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দুদকের চেয়ারম্যান নিয়োগের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই কমিশনার পদে মোঃ হাবিবুর রহমান ও আবুল হাসান মনযুর মান্নানকেও নিয়োগ দেওয়া হয়।

দেশে দুর্নীতি ও দুর্নীতিমূলক কাজ প্রতিরোধের লক্ষ্যে ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু দুদকের জন্য সাংগঠনিক কাঠামো, নিয়োগ বিধি, মামলা ও তদন্ত পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি না থাকায় দুদক তার কার্যক্রম পরিচালনায় বারবার বাধার মুখে পড়ে। কোনো বিধি প্রণয়ন না করেই দুদক কার্যক্রম পরিচালনা করার উদ্যোগ নেয়ায় খোদ কমিশনারদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। এরপরও মামলা দায়ের ও তদন্ত পরিচালনার কাজ অব্যাহত থাকে।

চারদলীয় জোট সরকারের বিদায়ের পর গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে দুদকের চেয়ারম্যান পদ থেকে বিচারপতি সুলতান হোসেন খান এবং সদস্য মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা ও মনির উদ্দিন আহমেদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। চার বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া হলেও নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাদের বিদায় নিতে হয়। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দুদকের চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনারও পরিবর্তন হয়।

কে হচ্ছেন দুদক চেয়ারম্যান

দুদকের নতুন চেয়ারম্যান কে হচ্ছেন, তা নিয়ে শুরু হয়েছে গুঞ্জন। হাসান মশহুদ চৌধূরী গত দুই এপ্রিল পদত্যাগ করার পর রাষ্ট্রপতি কাকে এ পদে নিয়োগ দেবেন, সে বিষয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা। আইন অনুযায়ী পদ শূন্য হওয়ার এক মাসের মধ্যে রাষ্ট্রপতি এ পদে নিয়োগ দেবেন।

নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে ইতিমধ্যেই যাদের নাম শোনা গেছে তারা হলেনণ্ড সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান লে. জেনারেল (অব.) হারুন অর রশিদ, সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) জামালউদ্দিন, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন, সাবেক সমাজকল্যাণ সচিব আবদুল জব্বার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মহাপরিচালক মোঃ বদিউজ্জামান ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব খান আমীর আলী। আবদুল জব্বার, মোঃ বদিউজ্জামান ও খান আমীর আলী বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালক ছিলেন।

পরবর্তী পর্বে সংযুক্ত হবে সর্বশেষ পরিস্থিতি ও বিভিন্নজনের প্রতিক্রিয়া।

অবিশ্রুত

সেইসব দিন স্মরণে,- যখন কলামিস্টরা ছদ্মনামে লিখতেন; এমন নয় যে তাদের সাহসের অভাব ছিল, তারপরও তারা নামটিকে অনুক্ত রাখতেন। হতে পারে তাৎক্ষণিক ঝড়-ঝাপটার হাত থেকে বাঁচতেই তারা এরকম করতেন। আবার এ-ও হতে পারে, সাহসকেও বিনয়-ভুষণে সজ্জিত করেছিলেন তারা। আমারও খুব ইচ্ছে দেখার, নামহীন গোত্রহীন হলে মানুষ তাকে কী চোখে দেখে... কাঙালের কথা বাসী হলে কাঙালকে কি মানুষ আদৌ মনে করে!

১ comment

  1. মাসুদ করিম - ১৭ এপ্রিল ২০০৯ (১:৫৫ অপরাহ্ণ)

    হাসান মশহুদ চৌধূরী কোনো ব্যক্তি বা কোনো সংস্থার চেয়ারম্যান ছিলেন না। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণত একটি প্রক্রিয়ার অংশ। যে প্রক্রিয়ার সবাই সংসদ নির্বাচনের পরে বিদায় নিলেও কয়েকজন রয়ে গেলেন : মঈন-ইউ-আহমেদ, নির্বাচন কমিশানাররা, দুদক কমিশানাররা। এটা দুর্ভাগ্যজনক সবার আগে তাকেই বিদায় নিতে হলো, ভেবেছিলাম জুনে মঈন-ইউ-আহমেদের বিদায়ের পরে তিনি বিদায় নেবেন এবং সেসাথে পুরোপুরি ওই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত অন্য সবাই পর্যায়ক্রমে বিদায় নেবেন। কিন্তু কেন যেন হাসান মশহুদ চৌধূরীকে আগে বিদায় নিতে হলো। কেন যেন মনে হয় কোনো কারণে তিনি সামরিক প্রশাসনের আস্থা হারিয়েছিলেন। বাংলাদেশে সামরিক প্রশাসন যেরকম শক্তিশালী সেখানে প্রধানমন্ত্রীর বা সাংসদদের প্রতিক্রিয়া একজন প্রতাপশালী অবআর্মি বিদায় নেবেন এ আমার বিশ্বাস হয় না।
    সব রাস্তা রোমে যায়। পিলখানার ঘটনার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ১২টি শর্ত জুড়ে একটি নোট প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া হয়েছিল, সে নোটের শর্তগুলো আমরা কেউই জানি না, নোটের পাশাপাশি সেদিন সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা হয়েছে, সেখানে আরো কি কি মৌখিক শর্ত জুড়ে দেয়া ছিল তার কিছুই তো আমাদের দ্বারা জানা সম্ভব নয়। কিন্তু এটুকু দেখেছি তার পর থেকে একটা অশুভ সমঝোতা হয়েছে, এক অর্বাচীন আওয়ামীঅবআর্মিকে পিলখানা ঘটনার সমন্বয়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, তার অবিবেচনাপ্রসূত বিভিন্ন মন্তব্যে তদন্তের হিমঘর তখনই দেখতে পেয়েছি। আর খারাপ লেগেছে আমাদের রায়হান রশিদের জন্য, যিনি আলামত বিশ্লেষন ও তদন্ত প্রক্রিয়ার গতিপথ কী হওয়া উচিত তা নিয়ে অত্যন্ত উঁচুমানের আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন।
    আমার মনে হয় পিলখানা ঘটনার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানের সাথে প্রধানমন্ত্রীর ওই আলোচনার পরপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে কিছু অলিখিত অঘোষিত সামঞ্জস্যের রফা হয়েছে এবং সরকারও কিছু শর্তে তা মেনে নিয়েছেন এবং তার ফলেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে শক্তি অক্ষের কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, এবং সে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে হাসান মশহুদ চৌধূরী প্রক্রিয়ার অপ্রয়োজনীয় অংশ হয়েই টিকটিকির লেজের মতো খসে পড়েছেন।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.