একজন রাখাল শিক্ষকের জীবনযাপন

বছর বিশেক আগের কথা। সকাল সাতটা সাড়ে সাতটা হবে। আমি তাড়াহুড়ো করে বেরুচ্ছিলাম ভার্সিটিতে যাবার জন্য। ট্রেন ৮.১০মিনিটে। আগে বেরুলে সিট পাওয়া সহজ হবে। প্রতিদিনকার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভ্রমনযুদ্ধ। সিট দখল হল দখলের মতো মারাত্বক আকার ধারন না করলেও, মৃদু হাতাহাতি নিয়মিত দৃশ্য হয়ে উঠছিল। তাই সকালটা তাড়াহুড়ো করে বেরুই।

হঠাৎ বাইরে কচ্ কচ্ শব্দ শুনে জানলা দিয়ে উঁকি দিলাম সামনের বাগানে। আমাদের টিনশেড বাড়ীর সামনে একফালি খোলা জায়গা, কিছু ফুল আর অন্যান্য গাছপালা অযত্নে লাগানো। ঘন লম্বা লম্বা ঘাস কোমর পর্যন্ত লম্বা হয়ে বেড়ে উঠেছে। জংলা টাইপ জায়গা। ওই ঘাসের জঙ্গলে কিছু একটা নড়ছে। শব্দটা ওখান থেকেই আসছে। ভাবলাম কোন দুষ্টু বাচ্চা বেড়ার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেছে। ‘কে–রে’ বলে ডাক দিতে যাবো, এমন সময় ওখান থেকে যে মাথাটা উঠে দাড়ালো, তাকে দেখে ডাক দেয়ার বদলে লুকিয়ে পড়লাম পর্দার আড়ালে। খালি গা, লুংগিতে মালকোচা মারা, মাথায় গামছার পট্টি, তার উপর বসানো ঘাস ভর্তি টুকরি। কাঁচিটা কোমরে গুঁজে যে মানুষটা বেড়ার ঝাঁপি দরজা গলে বেরিয়ে গেল, সেই মানুষটার নাম আবদুল খালেক। একজন প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক। থাকেন আমাদের বাসার উত্তর-পশ্চিম কোনে। উনাকে দেখে লুকিয়ে পড়ার কারন হচ্ছে উনাকে যতবার দেখি এভাবে ঘাস কাটতে আমার ভেতর একটা অপরাধবোধ জাগে। মনে হতো আমাকে দেখে উনি বিব্রতবোধ করতে পারেন। একজন শিক্ষক গরুর জন্য ঘাস কাটছেন রাখালের মতো, ব্যাপারটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগতো। গ্রামে হলে তাও হতো। এই মেট্রোপলিটন শহরে একজন স্কুল শিক্ষক পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য যা করছেন তা আমার মাথা নীচু করে দিতো। কিন্তু ওনার নিজের মধ্যে কোন সংকোচ দেখিনি এ ব্যাপারে।

আমাদের পাড়াটা তখনো গড়ে ওঠেনি ভালমত। রাস্তাটা ছিল মাটির। শহরের মধ্যে হলেও রাস্তা ভালো ছিলনা বলে জায়গাটা তখনো আবাসিক এলাকার মর্যাদা পায়নি। আমাদেরও প্রায় নতুন বাড়ী। পেছনে ধূ ধূ প্রান্তর । সেই প্রান্তরের মাঝখানে একটুকরো জায়গায় ছোট্ট একটা বেড়ার ঘর। ঘরের পাশে  একচালা বেড়ার নীচে দুটি গরু আর বাছুর বাঁধা আছে। চারপাশে সবুজ ধানের জমিবেষ্টিত সেই ঘরটা খালেক স্যারের। স্ত্রী আর ৫ ছেলেমেয়ে নিয়ে বসবাস করছেন অনেক দিন ধরে। ঘরের লাগোয়া একটা বেড়ার চালাতে গরু-বাছুরের সংসার। শহরের মাঝখানে যেন ছোট্ট একটা গ্রাম্য পরিবেশ। আমি যে স্কুলে পড়তাম উনি সে স্কুলের প্রাইমারী সেকশানে পড়ান। ফজরের নামাজের পর পরই উনি গরুর পরিচর্যা করা, গরুর জন্য ঘাস কাটা ইত্যাদিতে লেগে যেতেন। বাইরের মাঠে ঘাসের ষ্টক শেষ হলে আমাদের বাসার সামনের অংশে চলে আসতেন ঘাস কাটতে। সত্যি কথা বলতে কী, উনি যখন রাখালের কাজ করতেন, উনাকে দেখে রাখালই মনে হতো। অচেনা কেউ উনাকে এ অবস্থায় দেখলে  বিশ্বাসই করবে না, এই মানুষটিই ঘন্টা দুই পরে বেত নিয়ে ক্লাসে ঢুকবেন মানুষ গড়ার কারিগর হয়ে।

হায়, উপলব্ধির বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছার আগে আমরা বোধ হয় সম্মানের বদলে উনাকে করুনাই করতাম। এরকম একজন মানুষ আমাদের সমাজে ভদ্রভাবে ঠিকে থাকতে পারে না। আর যাই হোক, কেবল মাষ্টারী করে আর দুধ বেচে এ যুগে কেউ টিকে থাকতে পারেনা। উনিও টিকবেন বলে আমাদের কারো বিশ্বাস ছিলনা। তাছাড়া এতগুলো ছেলেমেয়ে উনার সংসারে। কাউকেই মানুষ করতে পারবেননা হয়তো। বড়জোর স্কুল পাশ। মনে মনে বোধহয় তিরষ্কারই করতাম স্যারের জন্মনিয়ন্ত্রন সংক্রান্ত অসচতেনতার জন্য। বাংলাদেশের বেশীরভাগ দরিদ্র মানুষ অধিক সন্তানের বোঝায় বিপর্যস্ত, কিন্তু সামর্থ্যবান মানু্ষের সন্তান-সন্ততি একেবারেই কম। সংসারে টিকে থাকার জন্য খালেক স্যার স্কুলের চাকরীর পাশাপাশি, টিউশানি করতেন, তাতেও না কুলালে গরু পালতে শুরু করেন, কিন্তু হাল ছাড়েন নি। পাড়া-পড়শিদের কাছে উনি ছিলেন কোনমতে টিকে থাকার কারিগর। এর বেশী কেউ আশাও করে না।

কিন্তু সবার ভবিষ্যতবানী সম্পুর্ন ভুল প্রমান করতে এই মানুষটার মাত্র কয়েক বছর লেগেছিল। ৭/৮ বছরের ব্যবধানে আমরা তাঁর এক ছেলেকে ডাক্তারী, আরেক ছেলে ইন্জিনিয়ারিং পাশ করতে দেখলাম  বিষ্ময়ের সাথে । বাকীগুলোও বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে ততদিনে।  ছেলেমেয়েদের এরকম সাফল্যের কোন ছাপ ওনার জীবন যাত্রায় পড়েনি। রয়ে গিয়েছিলেন আগের মতোই। যেন – ওরা ওদের কাজ করেছে, আমি আমারটা করি।

কিন্তু ছেলেমেয়েদের মানুষ করার নিজস্ব চমকপ্রদ একটা পদ্ধতি ছিল। উনি অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশোনার ব্যাপারে ছেলেমেয়েদের কোন চাপাচাপি করতেন না। কোনমতে পাশ করতে পারলেই হলো। কিন্তু নবম শ্রেনী থেকে উপরের দিককার পড়াশোনার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস ছিলেন। রীতিমতো খোঁজখবর নিয়ে খুব যত্ন নিয়ে তাদের পড়াতেন। যার ফল তিনি হাতে নাতে পেয়েছেন পরবর্তীকালে।

খালেক স্যারের বয়স হয়েছে এখন, ছেলেমেয়েরাও প্রতিষ্ঠিত। তবু স্কুলে যান এখনো প্রতিদিন। গরুগুলো বেচে দিয়েছেন। গরু চরার জায়গাগুলোতে আশে পাশের মানুষের বিশাল বিশাল দালান উঠেছে। মাঝখানে ছোট্ট ঘরটাতে উনি এখনও বাস করেন। পরের প্রজন্ম জানবেও না এই মাটির উপর একজন মানুষ কীভাবে টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন তিন যুগের বেশী সময়।

নীড় সন্ধানী

অদেখা স্বপ্নের ব্যাপ্তিটা প্রতিদিন বিস্তৃত হতে থাকে.........

১ comment

  1. সৈকত আচার্য - ১২ অক্টোবর ২০০৮ (১:৩৪ পূর্বাহ্ণ)

    রাখাল শিক্ষক, জনাব আবদুল খালেক সাহেবকে প্রনতি জানাই। দারিদ্রপীড়িত ও ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পারিবারিক কাঠামোর ভিতর বাস করেও প্রচন্ড আত্মসম্মান নিয়ে জীবনকে কীভাবে মর্যাদাপূর্ন করা যায়, তার একটি সার্থক গল্প এটি। মর্যাদা বোধের মিথ্যা কোন ধারনা তার মধ্যে ছিল না, তাই ঘাস কাটা অন্য আর দশটি কাজের মতোই একটি প্রয়োজনীয় কাজ ছিল তার কাছে। কাজ ছোট কি বড় এরকম ভাবনা তাই স্বাভাবিক ভাবেই তার চিন্তার মধ্যে প্রবেশাধিকার পায়নি। আপনাকে ধন্যবাদ, এই মানুষটির কথা আপনার মাধ্যমে জানার সুযোগ হয়েছে বলে।

Have your say

  • Sign up
Password Strength Very Weak
Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
We do not share your personal details with anyone.